news | logo

২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৬ই মে, ২০২৪ ইং



ফরিদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল সিন্ডিকেটকাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রোগীরা

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯, ১৫:৪৬

ফরিদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল সিন্ডিকেটকাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রোগীরা

বিশেষ প্রতিবেদক, ফরিদপুর:
ফরিদপুর ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের নানা অনিয়ম-দূর্নীতি, সিন্ডিকেট চক্র আর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে প্রতিদিন হাজারো রোগী এখানে চিকিৎসা নিতে এসে বঞ্চিত হচ্ছে কাঙ্খিত সেবা থেকে। কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতায় প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসা সেবা প্রদানে সাধারণ মানুষের আকাঙ্খা পূরণ করতে পারছে না। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগীদের। শুধু রোগীরাই নয়; নানা বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মধ্যেও রয়েছে ক্ষোভ।
১৯৮৩ সালের ২৫ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি। চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৫ সালের ১লা আগস্ট। এরপর ২৫ শয্যা নিয়ে ফরিদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয় ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী। তিন যুগ পেরিয়ে সরকারি ও বেসরকারি অনুদানে প্রতিষ্ঠানটি পরিপূর্নতা পেয়েছে।
এ সমিতির অধিনে রয়েছে, হাসপাতাল, ডায়াবেটিক মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, ফরিদপুর হার্ট ফাউন্ডেশন নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। ২০০৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করে নার্সিং ইনস্টিটিউট। ২০০৯-১০ সেশনে শিক্ষার্থী ভর্তির মধ্য দিয়ে ফরিদপুর ডায়াবেটিক মেডিকেল কলেজ যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এটি দক্ষিন বঙ্গের একটি অন্যতম চিকিৎসাসেবা প্রদান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
কিন্তু বিশাল অবকাঠামো ও জনবল নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কলেবরে বৃদ্ধি পেলেও মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুৎ হতে বসেছে এ প্রতিষ্ঠানটি।
এই প্রতিষ্ঠানে আসা সিংহভাগ রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, এই হাসপাতালের উপর বৃহত্তর ফরিদপুরবাসীর ব্যাপক নির্ভরতা থাকলেও কর্তৃপক্ষের অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান জনগণের সেই আকাঙ্খা পূরণে সচেষ্ট নন। হাসপাতালে রোগীদের কাছ থেকে গলাকাটা ফি আদায় করা হয়। বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়।
রোগীদের সেবায় সরকার থেকে শুরু করে বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ডায়াবেটিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে বিপুল পরিমান অর্থসহ নানা ধরনের সহায়তা প্রদান করে আসছে। কিন্তু এ সমস্ত অর্থ ও সেবা সামগ্রীর কিয়দংশ রোগীদের সেবায় ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বিশেষ করে গরীব ও দুঃস্থ্য রোগীরা কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ চিত্র আউটডোর থেকে শুরু করে রোগ নির্নয় ও হাসপাতাল পর্যন্ত বিস্তৃৃত। অর্থাভাবে অনেক গরীব ও দুঃস্থ্য রোগীদের নূন্যতম সেবা নিয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে এ প্রতিষ্ঠান থেকে। আবার কাউকে চিকিৎসা না পেয়েও ফিরে যেতে দেখা গেছে।
সম্প্রতি হাসপাতালটির নানা অনিয়মের চিত্র দেখা গেছে সরেজমিন ঘুরে। সেখানে দুর দুরান্ত থেকে আসা রোগীদের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। প্রতিবেদকের কাছে রোগী ও তাদের স্বজনরা কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অসহযোগিতার নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। তারা অভিযোগ করেন সমস্যা সুরাহার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কখনোই সচেষ্ট নন।
একাধিক রোগী অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালে সেবার মান ভালো শুনে প্রতিদিন হাজারো রোগী এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। কিন্তু আসার পর রোগীদের নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। প্রথমেই ভোগান্তিতে পড়তে হয় সিরিয়াল নিয়ে। সিরিয়াল পেলে ডাক্তার দেখানোর পর বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা দেওয়া হয়। সেখান থেকে বলে দেওয়া হয় এখান থেকেই পরীক্ষা করাতে হবে, অন্য স্থান থেকে পরীক্ষা করা হলে সেই রিপোর্ট ডাক্তার দেখবে না। তারা আরো বলেন, অন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে রিপোর্ট প্রতি দ্বিগুন টাকা নিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এই হাসপাতালে ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত রোগীরা বেশি আসেন। তারা পড়েন সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে। একাধিকবার নানা সমস্যার কথা জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
এদিকে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদেরকেও নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বিশেষ করে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সিট ভাড়া কম হওয়ার কথা থাকলেও এখানে অন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চেয়ে সিটভাড়া সহ আনুসাঙ্গিক খরচ বেশি নেওয়া হয়। এর সাথে রয়েছে হাসপাতালের স্টাফদের অবহেলা। পাশাপাশি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় চিকিৎসকের দেখা মেলাও দুস্কর হয়ে পড়ে রোগীদের। অপরদিকে রোগীদের ছাড়পত্র দেওয়ার সময়ও ভোগান্তিতে ফেলে কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসক ছাড়পত্র দেওয়ার পরেও হাসপাতাল থেকে মুক্তি পেতে রোগী ও তার স্বজনদের চার থেকে পাঁচ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের হলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়না কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত রোগীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সকাল ৮টার মধ্যে রোগীরা হাসপাতালে আসলেও ডাক্তারদের দেখা মেলেনা। যদিও ডাক্তার আসেন, এসেই তিনি প্রথমেই বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের সময় দেন। এরপর শুরু হয় রোগী দেখা। এই সময়ের মধ্যে অনেক রোগীই চিকিৎসাসেবা না নিয়ে ফিরে যান বাড়িতে। আবার অনেক সময় ডাক্তারের রোগী দেখার সময় শেষ হয়ে গেলে অপেক্ষায় থাকা রোগীদের ফিরে যেতে হয় বিনা চিকিৎসায়। সকালে আসা রোগীদের সিংহভাগই হাসপাতালের বইধারী। বইধারী রোগীদের কাছ থেকে ভিজিট পাওয়া যায়না বলেই ডাক্তাররা এদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে উৎসাহী হয় না। কিন্তু রোগী সেবা প্রদানের নামে তারা হাসপাতাল থেকে মাসে মোটা অংকের বেতন ঠিকই তুলে নেন।
অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালের যে সময়টুকু ডাক্তারদের দেওয়ার কথা ওই সময়টুকু নানাভাবে কাটিয়ে দেন তারা। পরে ভিজিট নিয়ে রোগী দেখেন ডাক্তাররা। ডাক্তাররা হাসপাতালের সমস্ত সুযোগ সুবিধা নিয়েও রোগীদের সাথে এধরনের আচরণ করলেও তা প্রতিকারে কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করেনি।
এদিকে এসব প্রতিষ্ঠানে বিগত পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে চাকরি করলেও অনেকেরই বেতন বাড়েনি। অথচ মাত্র দু’বছর চাকরি করছেন এমন কর্মচারীর বেতন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ানো হয়েছে। আবার কর্মচারীদের ওভারটাইমের বিল দেয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারী নিয়ম। কতিপয় কর্মচারী কাজ না করেও ওভারটাইওমের নামে বিল তুলে নিচ্ছেন। কর্তৃপক্ষের এ অনিয়ম নিয়েও কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। কিন্তু চাকরী হারানোর ভয়ে তারা নিরবে সব সহ্য করে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই জানান, এ প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত যেসব জিনিসপত্র কেনা হয় সেখানে কখনোই স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয় না। মালামাল ক্রয় ও সংস্কার কাজে দরপত্র আহ্বানের নিয়ম থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি কখনই তা করে না। নিজেদের পছন্দের লোকদের দিয়ে কাজ সম্পন্ন করে থাকে। কয়েক মাস আগে চারটি লিফট ক্রয় করা হয়। এ ক্ষেত্রেও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। আবার ওই লিফটগুলো কোনো ধরনের সার্ভিসিং না করেই প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের বিল ভাউচার করা হয়।
সূত্র জানায়, প্রতিবছর সরকারি-বেসরকারি নানা উৎস থেকে অনুদান ও সহায়তা প্রদান করা হয় ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি ও তার অধীনস্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে। এসব টাকা খরচে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। এতোবড় একটি প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অডিট কখনোই স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়নি। দূর্নীতির তথ্য গোপন করে দায়সারা অডিট রিপোর্ট তৈরি করা হয়ে থাকে।
এদিকে হাসপাতালে দরিদ্র ও সামর্থহীন রোগীদের জন্য অনুদান ও সহায়তা হিসেবে আসা ওষুধ সামর্থবানেরা লুটপাট করছে। ডায়াবেটিক মেডিকেল কলেজে ছাত্র ভর্তি নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। শিক্ষার্থী ভর্তি ক্ষেত্রে দরিদ্র মেধাবি কোটা থাকলেও সেটা অর্থের বিনিময়ে পেতে হয় শিক্ষার্থীদের। আবার কোনো কোনো বছর ভর্তির সময় দরিদ্রদের কোটা নেই বলে জানানো হয়।
সম্প্রতি অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগে ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালিত ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও নার্সিং ইন্সটিটিউটের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা ও অনিয়মের অভিযোগে চাকরি প্রার্থীদের ক্ষোভের মুখে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করেতে বাধ্য হয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগ উঠে, বিশাল এ নিয়োগ প্রক্রিয়াকে সামনে রেখে ডায়াবেটিক সমিতির নেতারা অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা চালান। তারা নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন তথ্য গোপন রেখে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের সুবিধা পাইয়ে দেয়ার জন্য শুরু থেকেই তৎপর ছিলেন। ইতিপূর্বেও তারা ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা অবলম্বন করে অনৈতিক সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট ডায়াবেটিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নানাভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে কব্জা করে অবৈধ সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ। ফলে চিকিৎসাসেবা প্রদানে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের আকাঙ্খা পূরণ করতে পারছে না।
ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতির অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা অনিয়ম দূর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার নেপথ্যে রয়েছেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শেখ আব্দুস সামাদ। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন মুরাদ মিয়া, চিত্তরঞ্জন ঘোষ সহ সমিতির কার্যর্নির্বাহী কমিটির কতিপয় সদস্য ও হাসপাতালের অসাধু কর্মকর্তা।
সমিতির সভাপতি মীর নাছির হোসেন ঐকান্তিকভাবে প্রতিষ্ঠানটির উন্নতি চাইলেও কতিপয় অসাধু সদস্যদের কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে দূর্নীতিমুক্ত করতে পারছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির এক সদস্য বলেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ আব্দুস সামাদসহ কতিপয় সদস্য সমিতিটিকে নিজের সম্পত্তি মনে করে ব্যবহার করছেন। নিয়োগ, ক্রয়, নির্মানসহ নানা বিষয়ে আর্থিক দূর্নীতি করছেন তারা। অনেক সময় এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়েছি, কিন্তু তারা একজোট হয়ে আমার সাথে দূব্যবহারও করেছে।
তিনি আরো বলেন, সভাপতি মীর নাছির সাহেব চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটিকে অনিয়ম দূর্নীতি মুক্ত করতে। কিন্তু তিনি ফরিদপুরের বাইরে থাকার সুযোগে নানা অনিয়ম করে যাচ্ছে ওই চক্রটি। ফলে প্রতিষ্ঠানটি সেবা প্রদানে কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছাতে পারছে না।
এ ব্যাপারে ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শেখ আব্দুস সামাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া সম্ভব হয়নি।




সম্পাদক ও প্রকাশক : মি. আহমেদ

অফিস লোকেশন:

১১০, গোয়ালবাড়ী, কাফরুল

মিরপুর-১৪, ঢাকা-১২০৬।

ফোন: ০১৯২২২৭৭৭৪৭ নিউজরুম: ০১৯২২২৭৭৭৩২

ই-মেইল: sales@bdwebs.com